ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ ও প্রতিকার: আতঙ্ক নয়, প্রয়োজন সতর্কতা ও সঠিক জ্ঞান
বর্ষা মৌসুম এলেই আমাদের দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যায়। এডিস মশার কামড়ে ছড়ানো এই ভাইরাসজনিত জ্বর নিয়ে মানুষের মধ্যে তৈরি হয় নানা আতঙ্ক ও ভুল ধারণা। তবে মনে রাখতে হবে, ডেঙ্গু নিয়ে আতঙ্কিত না হয়ে সঠিক তথ্য জানা এবং সময়মতো ব্যবস্থা গ্রহণ করাই সবচেয়ে জরুরি।
এই আর্টিকেলে আমরা ডেঙ্গু জ্বরের প্রাথমিক লক্ষণ, বিপদ চিহ্ন, ঘরোয়া প্রতিকার এবং কখন দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে, তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
ডেঙ্গু জ্বরের প্রাথমিক লক্ষণগুলো কী কী?
এডিস মশার কামড়ের ৪ থেকে ১০ দিনের মধ্যে সাধারণত ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ প্রকাশ পায়। প্রাথমিক পর্যায়ে অন্যান্য সাধারণ ভাইরাল জ্বরের সাথে এর মিল থাকলেও কিছু নির্দিষ্ট লক্ষণ দেখে ডেঙ্গু সনাক্ত করা যায়।
- উচ্চ জ্বর: হঠাৎ করে তীব্র জ্বর (১০২-১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট) আসা ডেঙ্গুর প্রধান লক্ষণ।
- তীব্র মাথাব্যথা: জ্বরের সাথে অসহ্য মাথাব্যথা অনুভূত হয়।
- চোখের পেছনে ব্যথা: এটি ডেঙ্গুর একটি ক্লাসিক লক্ষণ। চোখ নাড়ালেই ব্যথা অনুভূত হয়।
- মাংসপেশি ও হাড়ে তীব্র ব্যথা: শরীরে এত তীব্র ব্যথা হয় যে, একে “ব্রেকবোন ফিভার” (Breakbone Fever) বা হাড়ভাঙা জ্বরও বলা হয়।
- বমি বমি ভাব বা বমি হওয়া: অনেকেই খাবারে অরুচি এবং বমি বমি ভাবের অভিযোগ করেন।
- শরীরে র্যাশ বা লালচে দাগ: জ্বর শুরু হওয়ার ৩-৪ দিন পর শরীরে লালচে র্যাশ দেখা দিতে পারে।
- চরম দুর্বলতা ও ক্লান্তি: রোগী খুব অল্পতেই ক্লান্ত হয়ে পড়েন।
বিপদচিহ্ন বা Warning Signs: কখন দ্রুত হাসপাতালে যেতে হবে?
ডেঙ্গু জ্বরের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাড়িতে সঠিক পরিচর্যার মাধ্যমে সুস্থ হওয়া সম্ভব। তবে কিছু লক্ষণ দেখা দিলে তা মারাত্মক বা হেমোরেজিক ডেঙ্গুর ইঙ্গিত হতে পারে। এই বিপদচিহ্নগুলো দেখা মাত্রই রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে।
- তীব্র পেটব্যথা: পেটে অসহনীয় ব্যথা হওয়া।
- ক্রমাগত বমি: দিনে তিনবারের বেশি বমি হওয়া এবং কিছুই খেতে না পারা।
- শরীরের যেকোনো স্থান থেকে রক্তপাত: নাক, দাঁতের মাড়ি, মুখ থেকে রক্তপাত অথবা বমি বা মলের সাথে রক্ত যাওয়া।
- শ্বাসকষ্ট বা দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস: শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া।
- শরীরে পানি জমা: মুখ বা পেট ফুলে যাওয়া।
- অতিরিক্ত দুর্বলতা বা অস্থিরতা: রোগী নিস্তেজ হয়ে পড়লে বা ছটফট করতে থাকলে।
- প্লাটিলেট কাউন্ট দ্রুত কমে যাওয়া: রক্ত পরীক্ষায় প্লাটিলেট কাউন্ট এক লাখের নিচে নেমে এলে বা দ্রুত কমতে থাকলে।
ডেঙ্গু হলে করণীয় ও ঘরোয়া প্রতিকার
জ্বর নিশ্চিত হলে বা লক্ষণ দেখা দিলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী বাড়িতেই রোগীর যত্ন শুরু করতে হবে।
১. পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিন
ডেঙ্গু শরীরকে অত্যন্ত দুর্বল করে দেয়। তাই রোগীকে সম্পূর্ণ বিশ্রামে রাখতে হবে। পর্যাপ্ত বিশ্রাম শরীরকে রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করার শক্তি জোগায়।
২. প্রচুর পরিমাণে তরল গ্রহণ করুন
ডেঙ্গুতে শরীর পানিশূন্য হয়ে পড়ে, যা সবচেয়ে ক্ষতিকর দিক তাই রোগীকে প্রচুর পরিমাণে তরল খাবার খেতে দিন। যেমন:
- খাবার স্যালাইন (ORS)
- ডাবের পানি
- লেবুর শরবত
- টাটকা ফলের রস (চিনি ছাড়া)
- পাতলা স্যুপ
৩. জ্বর নিয়ন্ত্রণের জন্য করণীয়
জ্বর কমানোর জন্য শুধুমাত্র প্যারাসিটামল জাতীয় ঔষধ চিকিৎসকের পরামর্শে খেতে হবে।
বিশেষ সতর্কতা: কোনো অবস্থাতেই অ্যাসপিরিন (Aspirin), আইবুপ্রোফেন (Ibuprofen) বা অন্য কোনো ব্যথানাশক (NSAIDs) খাওয়া যাবে না। এটি রক্তক্ষরণের ঝুঁকি মারাত্মকভাবে বাড়িয়ে দেয়।
৪. ডেঙ্গু রোগীর খাবার তালিকা
সহজে হজম হয় এমন পুষ্টিকর খাবার রোগীকে খেতে দিন। যেমন:
- পেঁপে এবং পেঁপে পাতার রস (প্লাটিলেট বাড়াতে সাহায্য করে বলে প্রচলিত আছে)
- ডালিম
- নরম সবজি সেদ্ধ
- জাউভাত বা নরম খিচুড়ি
- স্যুপ
৫. মশার কামড় থেকে সুরক্ষা
ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীকে অবশ্যই মশারির ভেতরে রাখতে হবে। কারণ কোনো সাধারণ এডিস মশা রোগীকে কামড়ে পরে অন্য সুস্থ ব্যক্তিকে কামড়ালে তারও ডেঙ্গু হতে পারে।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে আপনার করণীয়
প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম। ডেঙ্গু প্রতিরোধে সামাজিক সচেতনতা সবচেয়ে বেশি জরুরি।
- বাড়ির আশেপাশে জমে থাকা পানি (যেমন: ফুলের টব, ডাবের খোসা, পুরনো টায়ার) পরিষ্কার করুন।
- দিনে ও রাতে ঘুমানোর সময় মশারী ব্যবহার করুন।
- মশা তাড়ানোর স্প্রে বা লোশন ব্যবহার করুন।
- দিনের বেলাতেও সতর্ক থাকুন, কারণ এডিস মশা মূলত দিনের বেলাতেই কামড়ায়।
কখন এবং কেন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিবেন?
জ্বরের লক্ষণ দেখা দিলে অবহেলা না করে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। ডেঙ্গু হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত হতে NS1, CBC (Complete Blood Count) এবং IgG/IgM টেস্ট করার প্রয়োজন হতে পারে। একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারই পারেন রোগীর অবস্থা বুঝে সঠিক চিকিৎসা ও পরামর্শ দিতে।
আপনার কাছাকাছি মেডিসিন বিশেষজ্ঞ বা শিশু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে এবং দ্রুততম সময়ে ডায়াগনস্টিক সেন্টারে টেস্ট করাতে Medilisting.com-এ ভিজিট করুন। সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা জীবন বাঁচাতে পারে।
আরও পড়ুন- সিজারের পর দ্রুত সুস্থ হতে মায়ের করণীয় বিষয়গুলো কি কি?
ডায়াবেটিস নিয়ে দুশ্চিন্তা? জেনে নিন নিয়ন্ত্রণের সেরা তিনটি উপায়।